ও৩ম্

শিব কে?

শিবকে অজর-অমর বলা হয়ে থাকে। তিনি কল্যানকারী, দয়ালু এবং তিনি খুব সহজেই প্রসন্ন হয়ে যান। কে এই শিব? কেমন তিনি? তাঁর কর্তব্য কী? এটি দেখতে হলে আমাদের প্রাচীন বৈদিক ও পৌরাণিক উভয় সাহিত্যের দিকে অবলোকন করতে হবে।

পৌরাণিক সাহিত্যে শিবের নামে অনেক গল্পের সৃষ্টি হয়েছে এবং শিবকে বহু নামে উল্লেখ করা হয়েছে। সেগুলোকেও নানাভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। একটি বিষয় স্পষ্ট যে, বেদ থেকেই তাদের অর্থাৎ সেসব নামসমূহের প্রত্যেকেরই উৎপত্তি। কিন্তু আমরা দেখি বেদে বর্ণিত শিব এবং পরবর্তী সাহিত্যে বর্ণিত শিবের মধ্যে বিরাট পার্থক্য রয়েছে। প্রকৃতপক্ষে, বেদে বর্ণিত শিব হল সৃষ্টির নিয়ামক শক্তির একটি রূপ। পরবর্তী পৌরাণিক সাহিত্যে আমরা শিবের যে রূপ দেখতে পাই, তা ইতিহাস ও কল্পনার এক অপূর্ব সমন্বয়। যদিও বেদে এই নামটি আধ্যাত্মিক দিকটিকে দৃঢ় করে। মহাভারতে আমরা শিবকে একটি ঐতিহাসিক চরিত্র হিসাবে দেখি কিন্তু পৌরাণিক সাহিত্যে এটি একটি অত্যন্ত বিকৃত অবস্থা তৈরি করেছে। এটি দুর্ভাগ্যজনক যে আজ এই বিকৃত রূপ আমাদের মাঝে সর্বত্র প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে।

শিবের বৈদিক আধ্যাত্মিক রূপ কীভাবে এই বিকৃত অবস্থায় পৌঁছেছিল তা অবশ্যই চিন্তা করার মতো নয় কী? বিকৃত হওয়া সত্ত্বেও, এটি আজ এ পর্যন্তও বিখ্যাত কারণ শিবের বৈদিক নামের প্রতিপত্তি সর্বদা অক্ষুণ্ণ রয়েছে, তবে প্রতিটি মত বিভিন্নভাবে তার ব্যাখ্যা উপস্থাপন করে তার মতামত নিশ্চিত করার প্রয়াসে আছে,বিভিন্ন পথ তৈরি করেছে, করে চলেছে।

সর্বপ্রথম আমরা বেদেই শিবের উল্লেখ দেখতে পাই। যজুর্বেদের ষোড়শ অধ্যায়ের দেবতা হলেন রুদ্র। এই অধ্যায়ে শিবের অনেক নাম একত্রে পাওয়া যায়, যেমন শিব, গিরিশ, নীলগ্রীব, সহস্রাক্ষ, হিরণ্যবাহু, গণপতি, পশুপতি, শীতিকণ্ঠ, কপর্দিন, ব্যপ্তকেশ, শতধন্ব, হস্ব, বামন, শম্ভু, ময়োভাব, শঙ্কর, ময়স্কর, শিবতর, ভূতনাম অধিপতি।

আমরা বেদে স্পষ্ট দেখতে পাই যে, এই সমস্ত নাম আজ পৃথিবীতে প্রচলিত অর্থ দেয় না। এসব নাম পরমাত্মার গুণবাচক সত্তার গুণবাচক পরিচায়ক।

কিছু পণ্ডিত বিশ্বাস করেন যে, বেদ সেই শিবের বর্ণনা দিয়েছেন যাঁর নামে বহু পৌরাণিক কাহিনী তৈরি হয়েছে এবং যাঁর পূজা-উপাসনা বৈদিক যুগ থেকে আজ অবধি চলছে। এমনকি শিবের অনেক নাম ব্যাখ্যা করার জন্য বিভিন্ন গল্পও রচনা করেছে। এই গল্পগুলো শুধু সৃষ্টির নিয়মের পরিপন্থী নয়, সাথে অযৌক্তিকও। এই গল্পগুলি কেবল শিবের প্রজ্জ্বল রূপকেই ধ্বংস করে না বরং এর সাথে অনেক অনৈতিক কার্যকলাপও যুক্ত করে কালিমালিপ্ত করেছে। এই গল্পগুলির লেখক শিবকে অজর অমর মানা ও জানা সত্ত্বেও, তাঁর ঐতিহাসিক রূপটি এমন জঘন্যভাবে উপস্থাপন করেছেন যে, আমরা কোন শিবকে অবলোকন করছি তা স্পষ্ট নয়।

রামায়ণে শিবের বর্ণনা

রামায়ণ নামে দুটি বইয়ের সাথে আমরা বিশেষভাবে পরিচিত। প্রথমটি হল বাল্মীকি রচিত রামায়ণ এবং দ্বিতীয়টি তুলসীদাস রচিত রামচরিতমানস। সাধারণত তুলসীদাসের রামচরিতমানসকে যে রামায়ণও বলা হয় তা সম্পূর্ণ ভুল। এই দুটি গ্রন্থের মধ্যে বিরাট পার্থক্য রয়েছে। শুধু ভাষার পার্থক্যই নয়, ঘটনাতেও রয়েছে ভিন্নতা। বাল্মীকির বিবরণ সত্যের কাছাকাছি, আমরা এটিকে সম্পূর্ণরূপে বিশ্বাস করতে পারি, অন্যদিকে তুলসীদাসের বিবরণটি ভক্তির চেতনায় লেখা মানবীয় ও অমানবীয় গল্পের এক অদ্ভুত মিশ্রণ। তুলসী দশরথের পুত্র রামকে নাকি সংসারের নিয়ন্ত্রক শক্তি বর্ণনা করছেন যা সঠিক নয়। একইভাবে রামায়ণে শিবের সম্পর্কেও কবি তুলসীর বর্ণনা ও একারণে নির্ভরযোগ্য বলে মনে করা যায় না। অতএব, আমরা দেখতে চাই বাল্মীকির রামায়ণে কোন শিবের বর্ণনা আছে। কারণ বাল্মীকি রামায়ণ হল প্রাচীনতম রাম কাব্য।

বাল্মীকি রামায়ণের বালকাণ্ডে, শিবের বর্ণনা প্রথম পাওয়া যায় তেইশতম সর্গতে। “বিশ্বামিত্রের সঙ্গে রাম-লক্ষ্মণ ভ্রমণ করছেন, এমনসময় আমরা যখন তাকে সরযু তটের তীরের পরে বনে নির্মিত একটি আশ্রম দেখে সে সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করি, তখন বিশ্বামিত্রের উত্তর নিম্নরূপ-

‘বুদ্ধিমানরা যাকে 'কামদেব' বলে অভিহিত করেন, তা ছিল কন্দর্পে (পূর্বে) দেহধারী। এখানে তিনি(শিব) নিয়মপূর্বক একাগ্রতার সাথে তপস্যা করার পর বিয়ে করার উদ্দেশ্যে মরুতদের সাথে যাওয়ার সময় কাম দ্বারা আক্রমণ হয়েছিলেন। মহাত্মা শিব গর্জন করলেন,রুদ্রের চক্ষু দ্বারা দগ্ধ হয়ে দুর্মতির (কাম) দেহের সব অঙ্গ পুড়ে গেল। মহাত্মা (শিব) তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ধ্বংস করে দিলো। দেবেশ্বর (শিব) ক্রোধে কামকে নিজ শরীররহিত করে দিলেন। হে রাঘব, সেই থেকে তিনি(শিব) অনঙ্গ নামে বিখ্যাত হয়েছিলেন। এটাই ছিল তাঁর (শিবের) প্রথম পূন্য আশ্রম।”

এই বর্ণনা থেকে জানা যায়, আগে এই আশ্রমে শিব নামে এক মহাত্মা তপস্যা করতেন। আর তিনি কোনোভাবেই নিজের শরীরে 'কাম'কে প্রাধান্য পেতে দেননি। উপরোক্ত বক্তব্যের পর এটাও বলা হয়েছে যে তিনি বিয়ে করতে যাচ্ছিলেন। এই বিবৃতিটি আমাদের কাছে বেমানান বলে মনে হয়। তারা যখন বিয়ে করতে রাজি, তখন তাদের 'কামে' লিপ্ত হতে হবে এটা নিশ্চিত। 'কাম" যখন শরীর রহিত করতে হতো তবে তখন বিয়ের কী আবশ্যকতা ছিল। স্পষ্টতই এই শিব বেদে উল্লেখিত শিব হতে পারে না। কারণ, এ শিব সম্পূর্ণ মানবীয় গুণাবলীতে পরিপূর্ণ। মানবীয় গুণাবলী, যোগী শিব কিভাবে হয়?

হরধনুক ভঙ্গের প্রসঙ্গে যে ধনুকটির নাম পাওয়া যায় তা জনক এর পূর্বপুরুষ তাকে দিয়েছিলেন। বিভ্রান্তিকর বক্তব্য এই যে এটি শিবের সাথে সম্পর্কিত ছিল। আরেকটি বিশ্বাস হল রাবণ শিবের ভক্ত ছিলেন যা শঙ্করাচার্যই প্রথম বিরচিত করে গিয়েছিলেন। আমরা যতদূর জানি, রামের সময়ে শঙ্করের অস্তিত্বই ছিল না। তাই রাবণের শিবের ভক্ত হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না,কারণ শঙ্করাচার্যের আগে কেউ তা বলেওনি, লিপিবদ্ধ ও করেনি। শঙ্কর প্রকৃতপক্ষে মহাভারতের সময়কালেই বিদ্যমান ছিলেন এবং তর্ক সাপেক্ষে ধরে নিলে বেদ থেকেও তার বর্ণনা বের করা সঙ্গত নয়। কারণ বেদে ইতিহাস নেই, কখনো থাকতেও পারেনা। তাই, রাবণ যে শিবভক্ত, তার প্রমাণ অনেকটাই দূর্বল হয়ে যায়।

রাম সম্পর্কে একই বিশ্বাস মানুষের মধ্যে প্রচলিত যে, রাম ছিলেন শিবের উপাসক। যদি বলা হয় যে রাম এই জগতের স্রষ্টা শিবের(পরমাত্মা) উপাসক ছিলেন তবে তা ঠিক, কিন্তু যদি মহাভারত ও পুরাণে বর্ণিত সেই শিবকে এখানে আরোপিত করা হয়, তবে তা ভুল হবে। বস্তুতঃ এই কেলেঙ্কারিটা করেছিলেন তুলসীদাস। তারাই শিব ও রামকে একে অপরের উপাসক বলে ইতিহাসের ক্রমকে কলুষিত করেছে। প্রায়শই রামের দ্বারা সেতু নির্মাণের উদাহরণ দেওয়া হয় এবং বলা হয় যে এই উপলক্ষ্যে,

রামের দ্বারা শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং আজ একই স্থানে রামেশ্বরম মন্দির বিদ্যমান। এ ঘটনা বাল্মীকি রামায়ণ থেকে প্রমাণিত নয়। প্রকৃতপক্ষে, এই মন্দিরটি ১১ শতকে নির্মিত এবং দক্ষিণ ভারতীয় রাজা রামচন্দ্র দ্বারা নির্মিত হয়েছিল, তাই এটির নাম রামেশ্বরম। এই রাজাই ছিলেন শিবের(পৌরাণিক) উপাসক।

যাই হোক, রাবণ প্রকৃত কার উপাসক ছিলেন তা আমরা অন্য একটি প্রবন্ধে আলোচনা করতে চাই।

মহাভারতের শিব

মহাভারতে বর্ণিত শিবকে আমরা দেখতে পাই একজন ঐতিহাসিক পুরুষ এবং অনেকাংশে মানবীয় ভাবনায় ওতপ্রোতভাবে জড়িত সত্তা । প্রকৃতপক্ষে, তিনি ছিলেন ভুটানের রাজা, যেটি সেই সময়ে অবশ্যই ভূতস্থান নামে বিখ্যাত ছিল, যা পরবর্তীতে ভুতান বা ভুটান হয়। এই অঞ্চলে বসবাসকারী লোকদের এখনও ভোট বা ভোটিয়া বলা হয় যা ভূত ও ভূতিয়ার অপভ্রংশ। প্রাচীনকালে এই অঞ্চল দেবতাদের (উত্তম গুণসম্পন্ন মানুষদের) আধিপত্য ছিল। এই অঞ্চলের আদি বাসিন্দা এবং দেবতাদের মিশ্রণ থেকে এই বর্ণের উদ্ভব হয়েছিল। ভূতের রাজা হওয়ার কারণে শিবকে ভূতপতি, ভূতেশ, ভূতনাথ ইত্যাদি বলা হয়।একইভাবে দেবজাতির জন্য মহাদেবও বলা হয়।

যদ্যাপি আজকের ভুটান একটি ছোট অঞ্চল হলেও তথাপি প্রাচীনকালে এই অঞ্চলটি বেশ বড় ছিল। এই কারণেই মহাদেবের সিংহাসন ছিল কৈলাশ পর্বতে এবং সেখান থেকে তিনি ভূত ও পিশাচদের উপরও রাজত্ব করতেন। পাহাড়ের রাজা হওয়ার কারণে তাকে গিরিশও বলা হয়। তার পত্নী পার্বতী অর্থাৎ পাহাড়ি নারী। পাহাড়ি রাজার বিয়ে পাহাড়ি নারীর সাথে থাকাটাই স্বাভাবিক। মহাভারতের এমন কিছু ঘটনা রয়েছে যা স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে তিনি একজন ঐতিহাসিক ব্যক্তি। অর্জুন পাশুপত অস্ত্র পেতে হিমালয়ে যান। এই অস্ত্র শুধুমাত্র শিবের কাছ থেকে পেতে হয়েছিল। কারণ, রাজা শিব তার পরীক্ষা নিবে।এই অস্ত্র শিব থেকে প্রাপ্ত হওয়ার কথা ছিল।

অারেকটা প্রসংগে গল্প এইযে শঙ্করের সাথে কৃষ্ণের যুদ্ধ হয়। বাণাসুরের পুত্রী উষার বিবাহ কৃষ্ণের পৌত্র অনিরুদ্ধের সাথে হয়েছিল এই কারণে বাণাসুরের সাথে কৃষ্ণের পৌত্রের যুদ্ধ হয়েছিল এবং শঙ্কর বাণাসুরের সহায়ক হয়েছিল এবং সে(অনিরুদ্ধ) যুদ্ধে হেরে গিয়েছিল।

মহাভারতে শঙ্করকে ‘ক্রতু’ বা ধ্বংসী বলা হয়েছে। যার অর্থ হলো যজ্ঞের বিনাশকারী। এই কাজ কোনো স্বধর্মী করতে পারে নাহ। আমরা দেখি যে এই শঙ্কর বা শিব সবসময় অসুরের এবং রাক্ষসের সহায়তা করতেন।

বাণাসুরের মতন অনেক রাক্ষসকে এ মহাদেবের সহায়তা মিলতো এবং তারা প্রবল হয়ে ভারতবাসীদের বিরক্ত করতো। প্রারম্ভে না সে দেবতাদের পক্ষপাতী ছিল না কোন আর্যদের সহায়ক বরং সে স্বতন্ত্র হয়ে নিজ রাজ্য পরিচালনা করতো। কিন্তু বিষ্ণুর প্রযত্নের ফলে তার(শিব) অনেকবার অসফলতা মিলেছে এবং নিজ অন্তিম দিন পর্যন্ত তাই তিনি দেবতাদের(জাতির) সহায়ক হয়েছিলেন।

সাংস্কৃতিক দৃষ্টি দিয়ে যদি আমরা দেখি তাহলে বুঝতে পারবো যে, এদের সভ্যতা অনেক নিকৃষ্ট পর্যায়ের। যে সময় বিষ্ণু(আর্য রাজা) রেশমী পীতাম্বর ধারণ করতো, সাধারণ ভারতীয় সুতির কাপড় পড়তো, সেখানে ভূতদের রাজা শঙ্কর(ভূদেবজাতির রাজা) কাঁচা চামড়ার বস্ত্র ধারণ করতো। যেখানে রাজায় কাঁচা চামড়া পড়তো সেখানে প্রজাদের কী হাল হবে তা সহজে অনুমেয়।

তার মানে রামায়ণের চর্মপরিহিত ভূদেব রাজা বেদের সে মঙ্গলবাচক শিবও নয়, রামায়ণের মনুষ্যদেহধারী সরযু নদীতীরে আশ্রমবাসী ঋষি শিবও নন।

পুরাণের শিব

পুরাণে শিবের রূপ অনেক বিকৃত। স্বয়ং শিবজীর উৎপত্তি ও তার পুত্রদের উৎপত্তি আদি অত্যন্ত কাল্পনিক। এখানে গণেশজীর উৎপত্তি সম্পর্কে আমরা একটু যদি বিচার করি তবে তা স্পষ্ট হয়ে যাবে। শিবজী যখন ঘরের বাইরে গিয়েছিলো তখন পার্বতী স্নান করার জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন।যখন তার দ্বারের রক্ষক রাখার আবশ্যকতা অনুভব হলো তখন তিনি দুই হাত ঘষে এক বালকের উৎপন্ন করেছেন এবং দ্বারে বসিয়ে দিয়েছেন। যখন শঙ্কর/শিব আসলো তখন সে বালকটি তাকে থামাতে চাইলো। শঙ্করের এই আচরণ টি বর্দাশ হলো নাহ তার। তাই, শঙ্কর তার ত্রিশুলের দ্বারা বালকের মস্তক কেটে ফেললো। পার্বতী যখন এই সংবাদটি জানতে পারলেন তখন তিনি বিলাপ করা শুরু করলেন। এই সমাচার যখন বিষ্ণু জানতে পারলেন তখন তিনি নিজ চক্রের দ্বারা একটি নবজাত গজ-শিশুর মস্তক কেটে সে বালকের গর্দানে লাগিয়ে দিলেন। এইভাবে বালক গণেশের জন্ম হয় ।

এই গল্পের ঐতিহাসিকতা এতটুকু যে শিবের পুত্র গণেশ ছিল। কিন্তু শেষ ভাগ হলো শতভাগ আজগুবি, তর্করহিত এবং অসম্ভব। অামরা জানি যে হাত ঘষার ফলে কোনো সন্তান উৎপন্ন হয় নাহ । পার্বতী যদি এইরকম করতে পারতো তাহলে তাকে শিবের সাথে বিবাহ করার আবশ্যকতা ছিল নাহ । এইদিকে শিব বুঝতে পারে নি যে সে আমার পুত্র। তাহলে তিনি কেমন অন্তর্যামী ছিলেন? তার ক্রোধের সকল সীমা পার হয়ে গিয়েছিলো। যোগী কি অল্পতেই ক্রোধান্বিত হন? কোনো বালকের মস্তক কেটে দেওয়া কী বিবেকহীনতা নয় ? তাকে তো বেঁধেও রাখা যেতে পারতো যেহেতু সে শিবের থেকে অধিক বলবান না। একইভাবে মাতা পার্বতীও দ্বিতীয়বার হাত ঘষে বাচ্চা জন্ম দিতে পারতো। অযথা কান্নাকাটির হেতু কি?

বালকের মাথার উপর পর হাতির বাচ্চার মাথা জোড়া লাগানো কোনো প্রকার যুক্তি সঙ্গত নয়। প্রথম তো এটাতেই ভূল যে সে বালকটির মাথা কেন জোড়া লাগানো হয়নি? সেটা তো সেখানেই পড়ে ছিল । সেটাকে খুজার কোনো আবশ্যকতা ছিল না কেন?? সেটা যদি নাই থাকে তবে অন্য বাচ্চার মাথা লাগানো যেতে পারত কিন্তু তাদের তো হাতির বাচ্চার মাথা লাগানোর ইচ্ছে ছিলো। আমার এই কথার সাথে কেউ দ্বিমত হতে পারবে নাহ যে হাতির বাচ্চা যতই ছোট হোক না কেন সেটির মাথা কখনো মানব শিশুর গর্দানে সঠিকভাবে বসানো সম্ভব নাহ। পৌরাণিক কথার মধ্যে এই প্রকার অনেক বিসঙ্গতি ভরে পড়ে রয়েছে যেটার কোনো যুক্তিপূর্ণ সমাধান নেই।

এটার অতিরিক্ত পুরাণে শিব পার্বতীর কাম-সম্বন্ধে চর্চা এতটা খুলে আলোচনা করা হয়েছে যে সেটি অশ্লীলতার সকল সীমা পার হয়ে গিয়েছে। সেটা আমি এখানে লিখতে চাই নাহ। পুরাণের অধ্যয়ন কর্তা স্বয়ং এই সব জানে এবং এইসব অশ্লীল প্রসঙ্গের উপর লীলাপোতী করার জন্য সেগুলোর আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা প্রস্তুত করার যথাসম্ভব প্রয়াস করেছেন। কিন্তু সত্য কখনো চুপ থাকে নাহ। আজ শঙ্করপূজা, লিঙ্গ-পূজাতে পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছে। এটা অসভ্যতার অধঃপতনের প্রতীক। ভারতীয় ইতিহাসের মধ্যকালে যখন বাম মার্গের আবির্ভাব হয়েছিল তখন লিঙ্গ-পূজার অত্যধিক প্রচার এবং প্রসার হয়েছিলো । ফলতঃ ভারতীয় আধ্যাত্মিকতা নিজ যারা হিমালয় পর্বতশ্রেণিকে প্রত্যক্ষভাবে দেখেছেন তারা সহজেই বুঝতে পারবেন। কল্পনা করুন যে, এক সময়ে যখন গগনে অর্ধচন্দ্র এমন অবস্থানে থাকে যে এটি হিমালয় পর্বতমালার পিছনের দিকে এত উচ্চতায় রইল, মনে হয় এটি হিমালয় পর্বতকে স্পর্শ করছে। তখন এটি মনে হবে যেন এটিকে পর্বতের উপরে স্থাপন করা হয়েছে। এই দৃশ্যই হলো চাঁদকে জটাজুটে স্থাপন করার ভিত্তি। শিবের মাথার উপরে যে চাঁদ দেখা যায়,তার মূল ব্যাখা হলো এটিই।

আরকেটি প্রবল প্রতীক হলো গঙ্গা, শিবজীর মস্তক থেকে নির্গত হয়েছে। সবাই জানেন যে, গঙ্গা হিমালয় পর্বত থেকেই উৎপন্ন হয়ে সেখান থেকে নিন্মভূমিতে বিচরণ করার পর বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে।

জটাজুট হিসেবে হিমালয় পর্বতশ্রেণির বিভিন্ন শিখরকে কল্পনা করা হয়েছে। এটাই হলো শিবজীর মস্তক থেকে গঙ্গা নির্গত হওয়ার ব্যাখা।

যদিও এ প্রসঙ্গে অনেক কাহিনী তৈরি হয়েছে। অনেক ব্যাখ্যাও উপস্থাপিত হয়েছে কিন্তু সেগুলো তর্কসঙ্গত বা যৌক্তিক নয়।

তৃতীয় বিশেষত্ব হলো শিবজীর তৃতীয় নয়ন। এই নেত্রটি বন্ধ থাকে কিন্তু শিবজী যখন নৃত্য করেন তখন এটি খুলে। শিবজীর তাণ্ডব নৃত্যে পৃথিবী কম্পায়মান হয় এবং সর্বত্র বিনাশ লীলা প্রারম্ভ হয়। তাণ্ডব নৃত্য প্রলয়ে রূপকসূচক। কল্পনা করুন, হিমালয়ের সুউচ্চ প্রদেশ কম্পন করতে লাগল এবং জ্বালামুখী রূপে অগ্নি বর্ষণ আরম্ভ হলো। প্রলয়কাল তখনই উপস্থিত হবে। এটি কেমন ভয়ংকর ও ধ্বংসাত্মক হবে তা কল্পনারও অতীত।

এরপর শংকরজীর গলায় সর্পমালা থাকে। এই দৃশ্যটি হিমালয়ের সাথে মিলে যায়। যেসময়ে মেঘ বলয় আকারে তুষারশুভ্র হিমালয় শৃঙ্গকে বেষ্টন করে, তা দেখে প্রতীত হয় যে, শিব রূপী হিমালয়ের গলায় সর্পের মালা। বেদে ‘অহি’ শব্দ দিয়ে মেঘকে বুঝানো হয়েছে এবং লৌকিক সংস্কৃতে একেই সর্পের পর্যায়ে বর্ণনা করা হয়েছে। অতঃএব এ মেঘকে সর্প রূপে কল্পনা করা হয়েছে। ঘূর্ণায়মান বলে ক্ষণে ক্ষণে আকার পরিবর্তনের কারণে গতিশীলও থাকে। আর এটিই হলো শিবজীর গলায় সর্পমালার মূল ধারণা।

শংকরজীর পত্নীর নাম পার্বতী হিসেবে প্রসিদ্ধ। পার্বতী শব্দের অর্থ হলো পর্বতে উৎপন্ন বনস্পতি। হিমালয়ের প্রেক্ষাপটে আমরা যদি কিছু মধ্যযুগীয় চিত্র অবলোকন করি, তবে দেখা যাবে যে, পার্বতী শংকরজীর কোলে বসে আছেন। মানবীয় দৃষ্টিতে বিবেচনা করলে পতি-পত্নীর এমন চিত্র শোভনীয় মনে হবে না। কিন্তু এটিকে যদি হিমালয় পর্বতে উৎপন্ন বনস্পতির সাথে সম্পর্কযুক্ত বা তুলনা করি তবে তা স্পষ্ট হবে। এই প্রসঙ্গে, আমাদের 'বৈদিক সম্পত্তি' পুস্তকের ১৯৫ পৃষ্ঠায় লেখা একটি পংক্তি স্মরণে আসে। লেখা আছে, "আমরা দেখতে পাই গাছপালা রূপে পার্বতী হিমালয় রূপ শঙ্করের কোলে প্রচুর পরিমাণে বিরাজমান।" শিবকে অজর-অমর বলা হয়। জন্ম-মৃত্যু-বিবাহের প্রশ্ন অজরের জন্য কিভাবে সিদ্ধ হয়? অন্যদিকে অন্তত মানব জাতির জন্য হিমালয়ও এই শ্রেণিতে পরে। হিমালয়ের উচ্চতা এবং বিশালতার কারণে এটিকে অজর-অমর বলা যেতেই পারে রুপক অর্থে।

এই বিষয়ে ‘বৈদিক সম্পত্তি’ গ্রন্থের পৃষ্ঠা ১৯৩ এ আমরা দেখতে পাই-

“যে পর্বত যত বেশি উঁচু হয়, তার অগ্নি তথা আগ্নেয় গিরি, তাপশক্তি প্রভৃতি বিষয়গুলো তত অধিক ও বলবান হয়। হিমালয় সবচেয়ে বিশাল এবং সুউচ্চ হওয়ার কারণে এর শক্তি, তাপ প্রভৃতিও অধিক হয়। এই শক্তিগুলো হিমালয়ে সঞ্চিত রয়েছে। এই শক্তিগুলো এখনো অক্ষুণ্ন রয়েছে। তাছাড়া এটি তর্কাতীত বিষয় যে, এমন শক্তিগুলো সৃষ্টির প্রারম্ভে পাওয়া যেতে পারে। এটা অনুমান করা যায় যে, পৃথিবীতে উৎপন্ন যত পর্বত রয়েছে সেগুলো থেকে হিমালয় পর্বত সুউচ্চ এবং সর্বোত্তম।

হিমালয় প্রাণীদের জন্য কল্যাণকারী, তাই হিমালয়রুপী নামবাচক শঙ্কর কল্যাণকারী। বহু নদী হিমালয় থেকে উৎপন্ন হয়ে প্রাণীদেরকে জল ও অন্য সুবিধা প্রদান করছে তাই হিমালয় প্রজাপতিও বটে।

পৃথিবীতে যত প্রাচীন সভ্যতা আছে সেগুলো কোনাকোনোভাবে হিমালয়কে বিভিন্ন নামে জানে। হিমালয়ের একনাম হলো মেরু। এটিকে ইরানে 'মৌরু', গ্রিসে 'মেরোস', দক্ষিণ তুর্কিস্তানে 'মেরুভ', মিশরে 'মেরই' এবং অ্যাসিরিয়ায় 'মোরুখ' বলা হয়। অতএব, নিশ্চিতভাবে হিমালয়ই আমাদের সদা স্থির অহিমালা পরিহিত ধ্যান ও শুভ্রময় আদিদেব মহাদেব।

যুগে যুগে শিব, শঙ্কর নামে বহু ব্যক্তি এসেছেন। তাই আবশ্যক বিষয় এই যে, আমাদের উচিত শম্ভু মহাদেবকে তাদের সাথে না মেলানো। বেদের শিব বা শঙ্কর হলেন একজন নিরাকার পরমাত্মার নাম যিনি অজন্মা এবং অনাদি। বাল্মীকি রামায়ণে শিব নামধারী কোনো মহাপুরুষের নাম অবশ্য আছে, কিন্তু এই মহাপুরুষ এবং মহাভারতকালীন শিব থেকে ভিন্ন। মহাভারতকালীন শিব সম্পর্কিত অনেক কথা পরবর্তীতে পুরাণসমূহে সংকলিত হয়েছে। যার কারণে ভ্রম উৎপন্ন হয় এবং সাধারণ জনগণ তাদেরকে একই ব্যক্তি মনে করে বিভ্রান্ত হয়। মহাভারতের শিব মানবীয় গুণসম্পন্ন। লিঙ্গ পূজা সম্পর্কিত কথা এই শিবের সাথে যুক্ত হয়েছে। হিমালয় পর্বতকে মানবীয়করণ করে এই শিবের সাথে মিলিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং অতিরিক্ত ভক্তি ভাবনায় তাকে দেবাদিদেব, পরম পুরুষ প্রভৃতি মানা হয়। এরূপ অযৌক্তিক মিলকরণের কারণে বহু অসঙ্গতির জন্ম হয়েছে। এক্ষেত্রে স্পষ্টীকরণ করার জন্য আমরা প্রথমে হিমালয়কে মানবীয়করণ করে ব্যাখ্যা করার উপক্রম করেছি।

আমরা দেখি- মানব মন সর্বদা সরলতার দিকে ধাবিত হয়, কিন্তু সরলতার বিপরীতে আমরা পরমপিতা শিবের বাস্তবিক রূপ জানার জন্য কষ্ট করতে চাই না এবং অনেক নিরর্থক কার্যক্রমে লিপ্ত থাকতে চাই। কেবল জড়বস্তুর পূজা-অর্চনা করে আমরা পরম ধার্মিক ব্যক্তি হিসেবে মেনে নিই। ঈশ্বরের আসল পূজা হলো তাঁর বাস্তবিক স্বরূপ জানা ও অনুভব করা - এটা মানতে চাই না। আমরা রোজ দেখি, বহু মঠ-মন্দিরে সবসময় ভিড় থাকে। প্রত্যেক ব্যক্তি নিজেকে ধার্মিক মনে করে, তাহলে তো জগতের সমস্ত মন্দ নাশ হয়ে যাওয়া উচিত। কিন্তু খারাপ বা মন্দ তো কমে যায় না। আমরা পরমপিতার নিকট এমন মন্দ আশা করি যে, আমরা সমস্ত খারাপ বা পাপ কাজ করবো এবং তিনি আমাদেরকে ক্ষমা করে দেবেন। এই অজ্ঞানের কারণে আমরা একের পর এক মন্দ কাজ করি, ভুল করি।

আমরা আশা করি যে, এই বিচার-সরণি প্রস্তুত করা হয়েছে, তা শিবের বাস্তবিক স্বরূপ জানতে অবশ্য সহায়ক হবে। যদি এরূপ হয় তবে আমাদের পরিশ্রম সার্থক হয়েছে বলে আমরা পরিচিন্তন করবো।

প্রকৃত শিব

হাজার হাজার বছরের পারস্পরিক বিভেদ, বিদ্বেষ ও হিংসার কারণে ভারতবর্ষের গৌরব শূন্য হয়ে পড়েছে। ভারতের গর্বের সূর্য অস্তমিত হয়েছে, রয়ে গেছে ভারতের উন্নত সংস্কৃতির নাম। সমস্ত দেশের গুরু ভারত নিজেকে শিষ্যের শ্রেণীতে রেখেছে।

আজ আপনাদের জানাব আসলে শিব কে ?

আমাদের সংস্কৃতিতে আধ্যাত্মিকতায় মূল। যেখানে পৃথিবীর অন্যান্য সংষ্কৃতি ভোগ বিলাসকেই সর্বস্ব করেছে সেখানে ভারতীয় সংস্কৃতি ত্যাগকে সর্বস্ব বলেছে, আধ্যাত্মিকতাতে যোগের বিশেষ মাহাত্ম্য আছে। যোগীই প্রকৃত শিব । .

যোগী এবং কৈলাশ

যোগীও কৈলাশে বসবাস করেন, পর্বত দৃঢ়তার প্রতীক । পর্বত ব্রতের প্রতীক। কৈলাশ প্রত্যক্ষ রূপ কীলাশ । সংস্কৃত সাহিত্যে এটার পরোক্ষ রূপ হল কলস = অমৃত এবং অশ = ভোজনকেই বলা হয়, অর্থাৎ যোগী অমৃত ভোজী হন । এই ভোজনে সেই চাতক ব্রতী হন । তিনি অমৃত ভোজন করে পর্বতের সমান দৃঢ় থাকেন । তিমি মৃত্যুর রহস্যকে উদ্ঘাটিত করতে চান।

যোগী এবং তৃতীয় নেত্র

সে দৃঢ়তার দ্বারা যোগী সামনে অগ্রসর হন। উনার সাধনায় অনেক বাধা উপস্থিত হয়, অনেকনপ্রকার সিদ্ধি সামনে উপস্থিত হয়। যোগেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ গীতায় বলেছেন :-

ইন্দ্রিয়াণি পরাণ্যাহুরিন্দ্রিয়েভ্যঃ পরং মনঃ।

মনসস্তু পরা বুদ্ধির্যো বুদ্ধেঃ পরতস্তু সঃ । ৩/৪২

এবং বুদ্ধে পরং বুদ্ধা সংস্তভ্যাত্মানমাত্মনা।

জহি শত্রুং মহাবাহো কামরূপং দুরাসদম্ ॥ ৩/৪৩

অর্থাৎ ইন্দ্রিয়সমূহকে শ্রেষ্ঠ বলা হয়ে থাকে। ইন্দ্রিয়সমূহ অপেক্ষা মন শ্রেষ্ঠ, মন অপেক্ষা বুদ্ধি শ্রেষ্ঠ, বুদ্ধি থেকেও অত্যন্ত শ্রেষ্ঠ সেই (আত্মা)। হে মহাবাহো (অর্জুন)! এভাবে বুদ্ধি থেকে আত্মাকে শ্রেষ্ঠ জেনে বুদ্ধি দ্বারা মনকে বশ করে কামরূপ দুর্জয় শত্রুকে ধ্বংস করো।

যোগী এবং ত্রিশূল

সংসারে তিন প্রকার দুঃখ আছে। যার মধ্যে সকল দু:খের সমাবেশ হয়।

১. আধ্যাত্মিক দুঃখ। নিজের মনের অহংকার, হিংসা, বিদ্বেষ এসব পুষে রাখলে এসব দ্বারা মানুষ নিজেই দুঃখ-কষ্ট পায়৷ তাই এগুলো আধ্যাত্মিক দুঃখ।

২. আধিদৈবিক দুঃখ৷ প্রকৃতিক বস্তুসমূহ, যাদেরকে আমরা দেবতাও বলি, তাদের দ্বারা যেসব দুঃখ-কষ্ট ভোগ করে সেগুলো আধিদৈবিক দুঃখ৷ যেমন— ঝড়, বন্যা, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, খরা প্রভৃতি৷

৩. আধিভৌতিক দুঃখ। অন্যান্য প্রাণী, মানব দ্বারা আমরা যেসব দুঃখ-কষ্ট পাই সেগুলো আধিভৌতিক দুঃখ।

এই দুঃখ সমূহ মূলত কর্মফলের সাথে সম্পর্কিত নয়। এগুলো মূলত ত্রিগুণাত্মক প্রকৃতির ফলে সংগঠিত হয়। এগুলো কর্মফল হলে মানুষের মধ্যে মোক্ষ (দুঃখ হতে মুক্তি) লাভের ইচ্ছে থাকত না৷ কর্মের ফলের অতিরিক্ত এই জগতে দুঃখ পেতে হয় বলে মানুষ এই দুঃখ থেকে নিজেকে রক্ষা করতে চায়।

এইসব দুঃখ থেকে পরিত্রান পাবার জন্য যোগী সর্বাত্মক প্রচেষ্টা করেন এবং অত্যন্ত পুরুষার্থী হন ।

"অথ বিবিধদুঃখাত্যন্ত নিবৃত্তিরত্যন্ত পুরুষার্থঃ" ( সাঙ্খ্য দর্শন ১/১)

এই তিন প্রকার কে দুঃখকে দূর করাই অত্যন্ত পুরুষার্থ । এই তিন প্রকার দুঃখকে যোগী শরীর, মন এবং আত্মা থেকে দূর করেন, যোগী সেই ত্রিবিধ দু:খকে নিজের মুষ্ঠিবদ্ধ করে ফেলেন । প্রকৃত যোগী জগত সংসারকে অভয় প্রদান করেন ।

যোগী এবং নন্দি (বৃষভ)

'নন্দি' নাদ শব্দের অপভ্রংশ রূপ। নাদ ধ্বনিকেই বলা হয়। যোগী নাদ (শব্দ ব্রহ্ম) শব্দে সমাধিস্থ থাকেন। তিনি 'ও৩ম্' নাদের প্রেমী হন। যোগ দর্শনকার মহাযোগী মহর্ষি পতঞ্জলি বলেছেন :-

'তস্য বাচকঃ প্রণবঃ, 'তজ্জপস্তদর্থমাবনম্'

অর্থাৎ যোগী প্রণবের জপ করেন । এটাই তার কাছে বৃষভ 'বৃষভো বর্ষণাৎ' যিনি সুখের বর্ষণ করেন।

এই বিষয়ে আরেকটা ব্যাখ্যা হল যোগী তার শ্বাস-প্রশ্বাসে অজপা জপের মধ্যে নিজেকে নিযুক্ত রাখেন। বেদে আত্মাকে হংস বলা হয়েছে, যেমন-

"হংসঃ শুচিষদ্...... অর্থাৎ আত্মা শুদ্ধ হবার কারণ হংস । হংসঃ হংসঃ হংসঃ এভাবে জপের সন্ধি হল হংস হংস হংস। এটার উল্টা রূপ ( সহং সহং সহং ) হল । এই আত্মা (শিব) শ্বাস প্রশ্বাসপ্রণালীতে ( সোহং সোহং সোহং ) এর জপ করে এবং এই নাদের উপর ধীর স্থিরতাকে ধারণ করে । এই কথা ঈশোপনিষদে সুন্দরভানে বর্ণিত আছে।

পূষন্নেকর্ষে যম সূর্য প্রাজাপত্য ব্যূহ রশ্মীন্ সমূহ ।

তেজো যত্ত রূপং কল্যাণতমং ততে পশ্যামি যোঽসাবসৌ পুরুষঃ সোহমস্মি ।

যহঃ অসো, অসৌ পুরুষঃ সঃ অহম্ অস্মি য. = যে, অসো = প্রাণের মধ্যে , অসৌ-এই, পুরুষঃ = পুরুষ আছে । স. সেটা, অহম্ = আমি অস্মি = ই । এই 'সোহম্' নাদ আত্মার অজপা জপ যা প্রতিক্ষণ নিরন্তর চলতে থাকে ।

যোগী এবং মুণ্ডমাল

যোগী তার অতীত জন্মকে জেনে নেন তিনি কোন শির বা মস্তকে ধারণ করেছিলেন । শির বা মস্তকবিহীন শরীর কখনো চেনা যায় না এইজন্য দেহবস্তু না বলে মুণ্ডমাল বলা হয়। তিনি অনেক জন্মের শরীর ধারণ প্রক্রিয়াকে চেনেন এবং এটাই তার মুণ্ডমাল । যোগেশ্বর কৃষ্ণ গীতায় বলেছেন:-

বহূনি মে ব্যতীতানি জন্মানি তব অর্জুন ।

তান্যহং বেদ সর্বাণি ন ত্বং বেত্থ পরন্তপ ॥ ৪/৫

হে অর্জুন! আমার এবং তোমার অনেক জন্ম অতীত হয়েছে। আমি ঐ সকল (জন্মের কথা) জানি। হে পরন্তপ! তুমি জান না।

যোগী এবং ভষ্ম

প্রত্যেক যোগী শরীর এবং আত্মা সম্বন্ধে খুব ভালভাবেই জ্ঞাত। তিনি জানেন 'অন্তবন্ত ইমে দেহা নিত্যস্যোক্তা শরীরিণ: "

এই দৈহিক শরীর ধ্বংসশীল, তিনি এই দেহের প্রতি আসক্তি ত্যাগ করেন, যোগী আধ্যাত্মবাদের আশ্রয় নেন, যোগী '-ভস্মান্তশরীরম্' এর গুরুত্ব স্বীকার করেন এবং এই দেহকে আত্মার চারপাশে আবৃত ছাই হিসাবে বিবেচনা করেন। তিনি ভস্ম যজ্ঞ ত্যাগ করেন এবং আধ্যাত্মিক যজ্ঞ শুরু করেন।

যোগী এবং গঙ্গা

জ্ঞানের গঙ্গা যোগীর মস্তিষ্কে আলোড়িত হয়, তিনি পরম গুরু পরমেশ্বরের সাথে সংযোগ স্থাপন করেন এবং তাঁর জ্ঞানকে ধারণ করে সমগ্র ভূমি ও জলকে প্লাবিত এবং আচ্ছাদিত করেন , অবশেষে অসীম সাগরে বিলীন হন। যোগী বোঝেন যে ভগবান মহান থেকে মহানতর এবং লঘু থেকে লঘুতর, বৃহৎ থেকে বৃহত্তর এবং তুচ্ছ থেকে তুচ্ছতর স্থানে অবস্থান করেন। এজন্য তার জ্ঞান সর্বত্র উপস্থাপন করা হয়। তিনি ভেদাভেদ ভুলে সবার জন্য ভালো করেন।

যোগী এবং দ্বিতীয়ার চাঁদ

চাঁদ আনন্দের প্রতীক। চাঁদ দেখলে স্বাভাবিকভাবেই মনে প্রসন্নতা উৎপন্ন হয়। 'চন্দ্রমা মনসো জাতঃ চাঁদ দেখে মনের অস্থিরতা দূর হয়ে যায়, এমন অবস্থায় যোগী আনন্দ পান। চাঁদের আরেক নাম সোম। সোমের কারণে যোগীর মধ্যে সৌম্য গুণের বিকাশ ঘটে। যোগী সোমরস পান করেন । দ্বিতীয়ার চাঁদকে পূর্ণিমার মতো ততটা পছন্দ করা হয় না, কারণ পূর্ণিমার পরে হতাশা জমা হয় আর দ্বিতীয়ার পরে আশা ক্রমশ শক্তিশালী হয়।

যোগী এবং সাপ

যোগীর কাম, ক্রোধ, লোভ, নেশা, মায়া, হিংসা, বিদ্বেষ প্রভৃতি বিষাক্ত অন্তরকে ত্যাগ করে বেরিয়ে আসে, তার অন্তরের চেতনা শুদ্ধ হয়। এই খারাপ অনুভূতি দ্বারা তাকে কষ্ট দেওয়া যায় না। সারা দুনিয়ার বিষধারীকে সে তার নিকট আমন্ত্রণ জানায়। তিনি এইসব থেকে বিশ্বকে মোক্ষ দেন। তারপর এইসব তার কাছে গহনার কাজ শুরু করেন

যোগী এবং নীলকণ্ঠ

যোগী বিদ্বান পুরুষের উপর পতিত বিভিন্ন কঠিন বিপত্তিকে দূর করার জন্য অনেক বড় থেকে বড় বাধার মোকাবেলা করেন। তাকে বোলতা, ভীমরুল৷ বিষধর সাপের মত আঘাত অপমান অসম্মান এসে বিষ ঢেলে দেয় কিন্তু তিনি অমৃত ভেবে নিয়ে আকন্ঠ পান করে নিয়ে সমাজকে বিন্দুমাত্রও ক্ষতিগ্রস্ত হতে দেন না।

যোগী এবং ব্যঘ্রচর্ম

যোগী হিংস্র প্রাণীতে পরিপূর্ণ বনে বাঘ ইত্যাদির হিংস্র প্রাণির লোমশ চামড়াকে তার পোশাক এবং আসন হিসাবে তৈরি করে। এর সাথে 'সিহ্বৎ' ইন্দ্রিয়কে দমন করে। অর্থাৎ তাদের সমস্ত আগুন ভিতর থেকে বেরিয়ে আসে এবং বাইরে ছুটে যায়। সে তাদের দ্বারা নিজেকে ঢেকে রাখে এবং আত্মারাম রূপে চিন্তা করে।

তাদের সব আগা ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে বাইরে ছুটছে। তিনি সেইসব দ্বারা নিজেকে ঢেকে রাখে এবং আত্মারাম রূপে ঠিকঠাকমত বিচরণ করতে থাকে।

যোগী এবং হিমালয় কণ্যা পার্বতী

'হিম আচ্ছাদনে' বলা হয়। আচ্ছাদন শব্দ অন্ধকারের সমার্থক। অন্ধকার হলো জগতের প্রতীক এবং প্রকাশ হলো পরমাত্মার প্রতীক। মধ্যস্থিত এই জীবাত্মা অন্ধকারের দ্বারা প্রকাশকে প্রাপ্ত করে এর থেকে পার্বতীর প্রকাশমান বুদ্ধি এটা আমার না থেকে উৎপত্তি হয়। 'ইদন্ন মম'ও এর বিশদার্থ।

'ইদমহমনৃতাৎসত্যমুপৈমি' এ সত্যের প্রাপ্তি অনিত্য থেকে।এখানে এই কথা বর্ণিত আছে -

স তস্মিন্নেবাকাশে স্ত্রিয়মাজগাম বহুশোভমানঃ মুমাং হৈমবতীং তাং হোবাচ কিমেতদ্যক্ষমিতি।। [কঠোপনিষদ]

অর্থাৎ সেই আকাশে এক নারী দেখা যায় যার নাম 'উমা' যে হৈমবতী ছিল- মনের 'উমা' দর্শন সেই প্রকাশময় প্রবৃত্তির পরিচায়ক।

উ= ব্রহ্ম মীবতে যয়া

ঊমা= ব্রহ্মবিদ্যাকে বলে।

যোগী ব্রহ্মবিদ্যাকে প্রাপ্ত করে নেয় পুনরায় তার সমস্ত কার্য যোগেশ্ব শ্রীকৃষ্ণের ভাষায়-

ব্রহ্মার্পণং ব্রহ্ম হবিব্রহ্মাগ্নৌ ব্রহ্মণা হুতম্।

ব্রহ্মৈব তেন গন্তব্যং ব্রহ্মকর্মসমাধিনা ॥ ৪/২৪

অর্থাৎ অর্পণ ব্রহ্ম, হবনীয় দ্রব্য ব্রহ্ম, যিনি হোম করেন তিনিও ব্রহ্ম, ব্রহ্মরূপ অগ্নিতে আহুতি প্রদান কর্মও ব্রহ্ম। ব্রহ্মকর্মে সমাধিস্থ সেই মানুষের প্রাপ্ত গন্তব্যও ব্রহ্ম।

এই শ্লোকে "সর্ব খল্বিদং ব্রহ্ম" (ছান্দোগ্য উপনিদ: ৩/১৪/১) এর অনুসারে সর্বত্র ব্রহ্মদর্শনরূপ সাধনকে যজ্ঞের রূপ দেওয়া হয়েছে। এর অভিপ্রায় হল যে, কর্তা, কর্ম এবং কারণ ইত্যাদির পার্থক্যে ভিন্ন ভিন্ন রূপে প্রতীয়মান সমস্ত পদার্থকে ব্রহ্মরূপে দেখার যে অভ্যাস-সেই অভ্যাসরূপ কর্মও এক প্রকার যজ্ঞ।

যোগী এবং ডমরূ

যোগী আবারও ডমরু বাজিয়ে নিজের ভাবনা স্ফুলিঙ্গকে ঘোষণা করে থাকে। 'ডমরু' শব্দটি পরোক্ষ রূপ, প্রত্যক্ষ রূপে 'দমরূ'। 'পরোক্ষ প্রিয়া হি দেবাঃ প্রত্যক্ষদ্বিষঃ' বিদ্বান পরোক্ষকে ভালোবাসে প্রত্যক্ষকে নয়।

'দমরূ' শব্দটি বিশ্লেষণ করে 'দম' ও 'রু' এই দুটি শব্দ পাওয়া যায়।

'দমঃ' দমনকে এবং 'রু' শব্দকে বলা হয়। অর্থাৎ তার প্রত্যেক কার্য থেকে' দমনাত্মক ধ্বনি' নিঃসৃত হয়। তিনি ইন্দ্রিয় দমনের পাঠ পড়ান। তিনি ভোগের রোগ থেকে ছাড়িয়ে, ত্রিশূলের অর্থাৎ ত্রিতাপের সংকট থেকে মানবকে মুক্ত করেন।

ভারতবর্ষ এবং শিব (যোগী)

ভারতবর্ষ যোগীদের জন্য প্রসিদ্ধ। ভারতীয়দের তিন চতুর্থাংশ সময় যোগ সাধনের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয়। রঘুবংশীয়দের মধ্যে তো অন্তিম সময়ে যোগবলে প্রাণ বিসর্জনের প্রথা ছিলো।

মহাকবি কালীদাসের ভাষায়-

যোগেনান্তে তনুত্যজাম্, রঘূণামন্বয়ং বক্ষ্যে।

অথবা, অথ স বিষয় ব্যাবৃত্তাত্মা যথাবিধি সূনবে. নৃপতি ককুদং দত্ত্বা যূনে সিতাতয় বারণম। মুনিবন তরুচ্ছায়াং দেব্যা তয়া সহশিশ্রিয়ে, গলিত বয়সামিক্ষাকূণামিদং হি কুলব্রতম্ ॥

মুনিব্রত গ্রহণ করা ইক্ষাকু বংশের কুলব্রত ছিলো।

বেদের মধ্যেও:

গিরীণাম চ নদীনাম। ধিয়া বিপ্রো অজা- যত।

পর্বতের গুহায়, নদী সঙ্গমে, বিপ্রের উৎপত্তি বুদ্ধি দ্বারা হয়ে থাকে। অস্থির ভেতর হৃদয়াকাশে ঈড়া, পিঙ্গলা ও সুষুম্মার সঙ্গমে বুদ্ধি থেকে বিপ্রত্বের উৎপত্তি হয়। ব্রাহ্মী বুদ্ধি উপলব্ধ হয়।

এ সকল পরম্পরা যোগসাধনের পরিচায়ক। এগুলো প্রত্যেক ব্যক্তিকে শিব বানাতো। সে দেশ, জাতি এবং প্রাণিমাত্র সকলের জন্য শিব প্রমাণিত হতো। প্রত্যেকে ভারতীয়ের কর্তব্য সে যেন নিজে শিবে রূপান্তরিত হয় এবং নিজের সন্তানকেও শিব হিসেবে তৈরি করে।

আজ সেই শিল্প আমাদের হাত থেকে চলে গেছে, আজ আমরা হস্তশিল্পে দক্ষ রয়েছি কিন্তু শিব বানানোর অনুভূতি আমাদের মন থেকে যায় নি এবং এর ভিত্তিতে সেই যোগী স্রষ্টা হিমালয়ের প্রতিটি পাথরের কাজকে শিব বলে মনে করেছিলেন। তারা শিবের আসল রূপ ভুলে গিয়েছিলেন এবং একদিন ফাল্গুন কৃষ্ণ ত্রয়োদশীর মধ্যরাতে, গুর্জর প্রদেশের টংকারা গ্রামে শিব ব্রতের দিন, যেখানে পুরুষ ও মহিলারা শিবের সৃষ্টি সম্পর্কে একত্রে ভাবতেন, কর্ষন জি (কৃষ্ণজি) তাঁর শিশু মুলশঙ্কর সহ শুধুমাত্র পাথরের মূর্তিটিকেই শিব মনে করে বসে ছিলেন এবং নিদ্রায় মগ্ন ছিলেন আর শিশুটি শঙ্করের মূর্তির সামনে সচেতন শিবের সত্যে মগ্ন ছিল।

গণেশ বাহন ভগবান শিবের মাথায় আরোহণ করার সাথে সাথে তিনি ভগবান শিবের সত্যতা বোঝার সুযোগ পেয়েছিলেন।তিনি তার পিতাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে প্রশ্ন করেছিলেন, কিন্তু কোন সন্তোষজনক উত্তর না পেয়ে সত্যের পুজারি সত্যান্বেষী প্রকৃত শিবকে খোঁজার জন্য বন, পাহাড়, পর্বত এবং গুহাতেও ঘুরে বেড়ান। পরিশেষে তিনি দক্ষ শিল্পী গুরু বীরজানন্দের হাতে পড়ে নিজেই প্রকৃত শিব হয়ে ওঠেন।এখানেই তিনি থেমে থাকেননি, তিনি আরও এগিয়েছেন।

কামদেবকে যিনি তার তৃতীয় চোখ দিয়ে ধ্বংস করা ত্রিনেত্র, আজীবন ব্রহ্মচারী ছিলেন এবং পার্বতীরূপ ব্রহ্মবিদ্যার পাণি গ্রহণ করেছিলেন। জ্ঞান গঙ্গাকে মানব সমাজের মাথা থেকে পা পর্যন্ত, ব্রাহ্মণ থেকে শূদ্রে প্রবাহিত করেছেন। সোমরসকে পান করে, একহাতে তিন শূলকে (ত্রিশূল) ধারণ করেন, অন্য হাতে বেদ ধারণ করেন এবং 'ওঁ' ধ্বনিতে উপবেশন করে ঘরে ঘরে বেদ প্রচার করেন, জগতের কল্যাণে তিনি একবার নয়, সতেরোবার বিষ পান করেন। মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী একজন সম্পূর্ণ যোগী যিনি ভগবান শিবের চেয়েও অত্যন্ত করুণাময় রূপে জনসাধারণের সামনে উপস্থিত হন।

শিব তৈরির পদ্ধতি তিনি আবার চালু করলেন। মাতৃমান্ পিতৃমান্,আচার্য্যবান্ পুরুষ বেদের রূপে। এই কারণেই তিনি নারী শিক্ষার উপর জোর দেন, গুরুকুলীয় শিক্ষা ব্যবস্থাকে উৎসাহিত করেন এবং বেদের শিক্ষাকে পুনরায় জনপ্রিয় করেন। জড়কে জীবন দান করেছেন। তিনিই ছিলেন প্রকৃত শিব, যিনি শিবের সন্ধানে বেরিয়েছিলেন এবং স্বয়ং শিব হয়েছিলেন।

শব এবং শিব

শব এবং শিব- এই দুই শব্দের মধ্যে (ি) ইকারের পার্থক্য। ইকার শক্তির প্রতীক। শব বলা হয় মৃতদেহকে। মৃতদেহ বা শব-এ জীবনী শক্তি থাকলে তা শিব হয়। মহর্ষি শ্রী স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী শিবতর হয়ে শব বা জীবন্মৃত দেহে শক্তি সঞ্চার করেছেন, তিনি মৃতপ্রায় জাতিকে জাগ্রত করেছেন। মানবমাত্র শিব বা শিবতর হতে পারে, শিবতম হতে পারে না, কারণ শিবতম তো কেবল পরমাত্মাই।

‘যো বঃ শিবতমো রসঃ’ অর্থাৎ আত্মা শিব হতে পারে, শিবতর হতে পারে,

কিন্তু শিবতম হতে পারে না।

অবতারী পুরুষ শিবতর হন যিনি স্বয়ং উদ্ধার লাভ করেন এবং ভবসাগর থেকে অন্যদের উদ্ধার করতে পারেন। উদ্ধার প্রাপ্ত হলো শিব, উদ্ধারকারী হলেন শিবতর এবং লক্ষ্য হলো শিবতম বা পরমাত্মা। বেদে ভগবান প্রাতঃকালের এবং সন্ধ্যায় অন্তিম মন্ত্রকে এই লক্ষ্যে প্রস্তুত করেন। যেমন:

নমঃ শম্ভবায় চ ময়ো ভবায় চ,

নমঃ শঙ্করায় চ ময়স্করায় চ,

নমঃ শিবায় চ শিবতরায় চ॥

এই মন্ত্রে সেই সমস্ত পদ্ধতি বর্ণিত হয়েছে। যা স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী তাঁর সংস্কার বিধি এবং সত্যার্থ প্রকাশ গ্রন্থে ব্যক্ত করেছেন। মন্ত্রটি হলো - শৈবোং কা মন্ত্র ১/৬। বৈদিকদের কাছে এটার পুরোটা আছে। পৌরাণিক বর্গ শিব পূজায় এই মন্ত্রটি বিনিয়োগ করে। বস্তুত এই মন্ত্রটি শিব নির্মাণের একটি কলা। বৈদিকদের থেকে পৌরাণিকরা শিখে থাকে। প্রত্যেক ব্য়ক্তির আবশ্যক যে, সে তার সন্তানকে ‘শম্ভবায় চ’ বা শান্তিপূর্বক উৎপন্ন করে। অশান্তিকে দূর করে শান্তি-ক্রান্তির সত্য পাঠ অধ্যয়ন করানোর সংস্কৃতি রয়েছে। বাস্তবে শান্তি দ্বারা কামুকতাকে তিলাঞ্জলি দিয়ে সুসন্তান উৎপন্ন করতে হবে। সে সন্তান সুখ দানকারী হবে। ‘শান্তি এবং সুখ’-ই হলো জীবনের লক্ষ্য। সমস্থ ভূমণ্ডলে যে শান্ত এবং সুখী মানব চায়, তাকে নিজের সন্তানকে শান্তি এবং সুখে উৎপন্ন করতে হবে। আজ প্রত্যেক ব্যক্তি মানস বা মন অশান্ত এবং প্রত্যেক ব্য়ক্তির মন তথা শরীর আধি-ব্য়াধিগ্রস্ত। এই পরিস্থিতিতে সন্তান শান্ত স্বভাব ও সুখী কীভাবে হতে পারে? শান্তোদ্ভব এবং ময়োভব সন্তাই শান্তি প্রদান করতে পারে। শান্তি ও সুখকারী শিক্ষা মাতা ও পিতা থেকে সন্তান লাভ করে। মাতা শান্তি শিক্ষা দেয় এবং পিতা সুখ শিক্ষা দেয়। যে সন্তান গর্ভ থেকে শুরু করে সমাবর্তন কাল পর্যন্ত শান্তি ও সুখের শিক্ষা লাভ করে, যে সন্তান নিজের শতায়ুর প্রথম চার ভাগ শান্তি ও সুখ লাভের উপায় শিখতে নিযুক্ত করে সে গৃহস্থ জীবনে প্রবেশ করে শান্তি ও সুখ প্রদানকারী হয় এবং সে গৃহস্থ নিজের আয়ুর তৃতীয় ভাগ পুনরায় বনে গিয়ে তপস্যার মাধ্যমে শিব হতে পারে। অশিব চিন্তা ও প্রবৃত্তি দগ্ধ হয়: আয়ুর শেষ ভাগে সন্যাসী হয়ে শিবতর হয়ে যায়। তিনি সংসারে শিব নির্মাতা গৃহস্থগণকে শিব নির্মাণের সঠিক শিক্ষা দেন এবং মৃত্যুর পর শিবতমে লীন হয়ে যান। শম্ভুঃ ময়োভূঃ = ব্রহ্মচারী। শঙ্করঃ ময়স্কর = গৃহী। শিব = বানপ্রস্থ এবং শিবতর হলো সন্যাসী। মহর্ষি শ্রী স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী শিবতর স্বরূপ গৃহীদের আসল শিব নির্মাণ শিক্ষা দিয়েছেন। এজন্য তিনি জীবিত ছিলেন এবং এজন্য মৃত্যুবরণ করেছেন এবং শিবতমে সুমধুর কোল প্রাপ্ত হয়েছেন। পূণ্যভূমি মথুরাতে সাড়ে পাঁচ হাজার বছর পরে দয়ানন্দ, দয়ানন্দ রূপে এসে সমস্ত সংসারকে এক অনুপম পন্থা দেখিয়েছেন।

শিবরাত্রি অনেক বার এসেছে এবং গেছে কিন্তু আর্যদের নবজাগৃতির সন্দেশ প্রদানকারী শিবরাত্রি বস্তুত বোধ রাত্রি রূপে আসল শিবরাত্রি হয়। এই শিবরাত্রিকে প্রত্যেক আর্য খুব শ্রদ্ধার সাথে মানে এবং যারা ঋষিতুল্য তারা নব নব শিক্ষা গ্রহণ করে।

🖋️ঋষিবংশজা:

Services

Follow us