"হে কৃষ্ণ! আমি কুন্তীপুত্রদের পত্নী, আপনার প্রিয়সখী এবং ধৃষ্টদ্যুম্নের মত বীরের ভগিনী হয়েও কি কোনভাবে কেশ স্পর্শের সহিত জোড় পূর্বক সভা উপস্থিত করাতে পারে? আমি তখন রজস্বলা ছিলাম, আমার বস্ত্রে রক্তের দাগ ছিল, একবস্ত্রা ছিলাম এবং লজ্জা তথা ভয়ে আমার শরীর কাঁপছিল। সেই দশায় দুঃখিনী অবলারূপ আমাকে কৌরবগণের সভায় বলপূর্বক নিয়ে এসেছে । পুরো সভায় রাজাদের মন্ডলীর মাঝখানে অত্যন্ত রজঃস্রাবের কারণে রক্ত নির্গত হচ্ছিল । সেই অবস্থায় আমাকে দেখে ধৃতরাষ্ট্রের পাপাত্মা পুত্রগণ ভীষণ উপহাস করছিল । পান্ডব, পাঞ্চাল ও যাদবরা জীবিত থাকা সত্ত্বেও ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রগণ আমাকে দাসীভাব উপভোগ করতে অভিলাষী হল । হে কৃষ্ণ! আমি ধর্মতঃ ভীষ্ম ও ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রবধু হয়। এরপরও তাঁদের সামনে বলপূর্বক দাসী বানানো হয়েছে । আমি মহাবলী পান্ডবদের নিন্দা করছি, যারা নিজের যশস্বিনী ধর্মপত্নীকে দুঃসহ দুঃখভারাক্রান্ত দেখেও অনায়সে নীর"হে জনার্দন! ভীমসেনের বলকে ধিক্কার জানাই, অর্জুনের গান্ডীবকেও ধিক্কার জানাই যারা সেই নরাধামী দ্বারা আমাকে অপমানিত হতে দেখেও সহ্য করেছিল । সাধুজনাচরিত সনাতনধর্ম পূর্বাপর প্রচলিত হয়ে এসেছে যে পতি ক্ষীণবল হলেও পত্নীকে রক্ষা করার চেষ্টা করবে। পত্নীকে রক্ষা করলে নিজের সন্তানও সুরক্ষিত থাকবে এবং সন্তানকে রক্ষা করলে নিজের আত্মারও রক্ষা হয়। আমার ৫টি পুত্র। আপনার পুত্র প্রদ্যুম্নের যেমন শূরবীর, ঠিক সেইরকমই আমার পুত্ররা মহারথী । তারা ধনুর্বিদ্যায় নিপুণ ও শত্রুদের কাছে অজেয় । তবুও দুর্বল ধৃতরাষ্ট্র পুত্রদের অত্যাচার কীভাবে সহ্য করে"অধর্মের মাধ্যমে পুরো রাজ্য হরণ করা হয়েছে । সব পান্ডবদের দাস বানানো হয়েছে এবং আমি, একবস্ত্রা হয়েও আমাকে কেশাকর্ষণপূর্বক জোড় করে সভায় নিয়ে আসা হয়েছে । অর্জুনের কাছে গান্ডীব ছিল, যা অর্জুন, ভীম ও আপনি ছাড়া অন্যকেও ব্যবহার করতে পারবে না । তারপরও আমার রক্ষা করতে পারি নি । হে কৃষ্ণ! ভীমের বল ধিক্কার জানাই, যা থাকা সত্ত্বেও দুর্য্যোধন এত বড় অত্যাচার করা সত্ত্বেও এখনও জীবিত এইভাবে ভীম তথা অন্য পান্ডবগণের বীরতা বিভিন্নভাব ব্যাখ্যা করে কুপিত হয়ে দ্রৌপদী বার বার তাঁর চোখের জল মুছতে মুছতে রুদ্ধ কণ্ঠে বললেন-"আমি পতিপুত্র-বিহীনা, আমার বন্ধু নেই, ভ্রাতা নেই, পিতা নেই এবং তুমিও আমার পক্ষে নেই । কারণ তোমরা সকলে তৎকালে আমাকে পরাভূত দেখেও বিশোকের ন্যায় অনায়সে উপেক্ষা করেছিলে । হে কৃষ্ণ! চার কারণে তোমাকে আমার সবসময় রক্ষা করা উচিত। এক তুমি আমার সম্বন্ধী, দ্বিতীয়ত গৌরব, তৃতীয় তুমি আমার প্রকৃত বন্ধু এবং চতুর্থতঃ তুমি আমার রক্ষা করতে সামর্থ্যবান ।"

যুধিষ্ঠিরের সাথে কথোপকথনঃ

এরপর যুধিষ্ঠিরের নিকট শ্রীকৃষ্ণের উক্তি-"যদি আমি জুয়া খেলার সময় দ্বারকায় অথবা তার আশেপাশে থাকতাম তাহলে আপনাদের উপর এই সংকট হতে দিতাম না। বিনা আহ্বানে আমি দ্যূত স্থানে আগমন করতাম । প্রথমত আমি জুয়া খেলার বিভিন্ন দোষ দেখিয়ে এই ক্রিয়া বন্ধ করতে চেষ্টা করতাম। আর যদি তাঁরা আমার মধুর ও হিতকর বাক্য না মেনে নিত তাহলে আমি বলপূর্বক বন্ধ করতাম। আর যদি সেখানে উপস্থিত সুদৃঢ় নামধারী শত্রু অন্যায়ের আশ্রয় গ্রহণ করে ধৃতরাষ্ট্রের সঙ্গ দিত তাহলে আমি সভাসদ জুয়াড়িদের শমনসদনের আতিথ্যগ্রহণ করাতাম । আমি দ্বারকায় এসে সাত্যকির মুখে এই দুঃখদ সমাচার পেয়েছি । এই খবর শুনে আমার মন উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছে এবং আমি তাড়াতাড়ি আপনাদের সাথে দেখা করতখন যুধিষ্ঠির শ্রীকৃষ্ণের কাছে জিজ্ঞাসা করেছে যে যখন এই দ্যূত ক্রিয়া আয়োজন করা হয়েছে তখন তুমি কোথায় ছিলে এবং কি করছিলে? শ্রীকৃষ্ণ বলল "সেসময় আমি শাল্বের সৌভ নামক নগরাকার বিমান বিনাশ করার নিমিত্তে গমন করেছিলাম, তার কারণ শ্রবণ করুন। আপনার রাজসূয় যজ্ঞে আমাকে অগ্রপূজার প্রশ্ন নিয়ে যে বিবাদ হয়েছে সে সময় আমি রাজা শিশুপালকে বধ করেছিলাম। তার মৃত্যুর সমাচার শুনে শাল্ব প্রচন্ড ক্ষেপে গিয়ে দ্বারকাপুরীতে পোঁছালেন । সে যাদবদের অনেক বালকদের বধ করে নগরীর সমস্ত উপবন ছিন্নবিন্ন করেন। দ্বারকায় পৌঁছার পর এইসব শুনে আমার মন রাগে ব্যাকুল হয় এবং শাল্বকে বধ করার নিশ্চিত করে নিই । শাল্বকে খোঁজ করার পর তাকে আমি সমুদ্রে এক দ্বীপে পেয়েছি । তখন আমি আমার পাঙ্চজন্য শঙ্খ বাজিয়ে যুদ্ধে আহ্বান করলাম । তার সাথে বেশ সময় ধরে যুদ্ধ হয়েছে এবং সবাই আমার দ্বারা পরাভূত ও নিপাতিত হল । এই কারণে আমি দ্যূতক্রীড়া সময় ঐ স্থানে উপস্থিত হতে পারিনি। দ্বারকায় পৌঁছে হস্তিনাপুরের দূর্যোধনের কার্যকলাপ শুনে তাড়াতাড়ি আপনাদের সাথে দে দেখা করতে চলে এলাম ।"

এই বিবরণে স্পষ্টত বোঝা যাচ্ছে, জুয়া খেলার সময় এবং পাণ্ডবরা পরাজিত হওয়া তথা দূর্যোধন ও দুঃশাসনের দ্বারা দ্রৌপদী প্রতি করা অভদ্র ব্যবহারের ঘটনায় শ্রীকৃষ্ণের উপস্থিত থাকা তো দূরের কথা এমনকি তিনি জানতেনই না, কারণ ঘটনার সময় তিনি শ্বালের সাথে যুদ্ধে ব্যস্ত ছিলেন । এই সমাচার যুদ্ধের পর দ্বারকায় পৌঁছার পর জানতে পেরেছেন।

Services

Follow us